প্রকাশিত: Sat, Jan 14, 2023 3:42 PM
আপডেট: Sun, May 11, 2025 2:25 AM

শিল্পী, সাহিত্যিক, গবেষক কিংবা বিজ্ঞানীরা কি এলিট নন?

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন

এইবারের ঢাকা লিট্ফেস্টে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি, জেনেছি এবং চিনেছি। লিটফেস্টে গিয়ে মনে হচ্ছিলো, আমি এক ভিন্ন জগতে এসেছি। মনে হচ্ছিলো এইটা তো বাংলাদেশ না বরং আমি যেমন বাংলাদেশ গড়তে চাই তেমন বাংলাদেশ দেখেছি। কেমন বাংলাদেশ চাই? যেখানে দেশের মানুষেরা নিজ দেশের সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করবে এবং একই সাথে ভিন দেশের  সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি নিয়েও আলোচনা করবে এবং শুনবে। এর মধ্যে যদি কেউ এলিটিজম খুঁজে পায় আমাদের সেই এলিটিজমই দরকার। শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী তো এলিটই হবেন। আমার কন্যা বিয়াংকা প্রতিদিন সকালে লিটফেস্টে গিয়েছে এবং রাত পর্যন্ত থেকেছে। দারুণ উপভোগ করেছে প্রতিটা দিন। শেষ দিনে ভিড়ের মধ্যে কষ্ট করে কোক স্টুডিওর কনসার্টও দেখেছে। 

হ্যাঁ, এখানে ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের একটু আধিক্য ছিল। তাতে ক্ষতি কী? দেশে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল দিয়ে সয়লাব হয়নি? তারা কি রবীন্দ্রনাথ পড়ে, নজরুল পড়ে? জীবনান্দ পড়ে? পড়ে না। তবে তাদের অনেকেই ইংরেজি সাহিত্য পড়ে। অনেক পড়ে। আমার কন্যাদের পড়ার লিস্ট অনেক রিচ। তাদের জন্যও তো ২১ শে বইমেলার মতো একটি মেলা হলে ক্ষতি কী? এই যে ইংরেজি মাধ্যমের জেনারেশন আমরা তৈরির সুযোগ দিয়েছি তাদের সাহিত্য ক্ষুধা মেটানোর পথতো আমাদের তৈরি করতে হবে। এই লিটফেস্টের কারণে ইংরেজি ভাষায় লিখিত সাহিত্য সংস্কৃতির নানা দেশের বই কেনার সুযোগ ঘটে। অনেকে কোক স্টুডিও নিয়েও সমালোচনা করে। এই কোক স্টুডিও বদৌলতে এই ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের কাছে লালনগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীতসহ আমাদের ফোক সংগীতকে ওদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে কারো কোনো ক্ষতি হচ্ছে? আমি এই লিটফেস্টের পুরো অনুষ্ঠানটি ছিলো অত্যন্ত গোছানো। এই লিটফেস্টকে কেন্দ্র করে বিশ্ববরেণ্য অনেক সাহিত্যিক এই দেশে এসেছে। তাদের সাথে আমাদের একটা মেলবন্ধনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখানে এসেছিল নোবেলজয়ী লেখক, বুকার প্রাইজ জয়ী লেখক। লেখকদের জন্য সবচেয়ে বড় অ্যাওয়ার্ড কিংবা পুরস্কারগুলোর অন্যতম হলো বুকার প্রাইজ। আজ পর্যন্ত ১০ জন ভারতীয় এই পুরস্কার পেয়েছে। দুইজন শ্রীলংকান এই পুরস্কার পেয়েছে। পাকিস্তানিরাও এই পুরস্কার পেয়েছে। আজ পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি এই পুরস্কার পায়নি। তবে এই লিস্টফেস্টে গিয়ে জানলাম এবং বুঝতে পারলাম দেশে ইংরেজি ভাষায় লেখক তৈরি হচ্ছে। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে আমাদের কেউ এই পুরস্কার পাবে। আমাদের দেশে অনুবাদ সাহিত্যও গড়ে উঠেনি। ফলে আমাদের সাহিত্য বিশ্বদরবারে তেমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না। ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যও তেমন হচ্ছে না। আমরা যদি কনজারভেটিভ হয়ে থাকি আমাদের ইংরেজি সাহিত্য জীবনেও বিকশিত হবে না। এই লিটফেস্টের কারণে এইবার ভারতীয় লেখক অমিতাভ ঘোষ, গীতাঞ্জলি শ্রী প্রমুখ লেখকদের কথা শুনতে পেরেছি। একই সাথে হাসিনা খান, সেজুতি সাহা, ইয়াসমীন হকদের কথা শুনেছি। প্রত্যেকটি সেশন খুবই উপভোগ্য ছিল। শুধু আলোচকদের কথাই না একই সাথে উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের প্রশ্নগুলোও অনেক উপভোগ করেছি। একটি দেশ তো তখনই এগোয় যখন সেখানে নানা মাত্রার শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান বিকশিত হয়। বর্তমান বিশ্ব মিল এবং মিলানোর বিশ্ব। দরজা জানালা বন্ধ করে আমাদের আগামী প্রজন্মকে কুয়োর মধ্যে বড় করলে হবে না। আমি এই লিটফেস্টে গিয়ে আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীদের দেখেছি। যারা ধধিশব! তাদের নিরুৎসাহিত করে কি আমাদের কোনো লাভ হবে? এলিটিজমকে গালি হিসাবে ব্যবহার না করে আমাদের সবার উচিত এলিট হওয়া। শিল্পী, সাহিত্যিক, গবেষক, বিজ্ঞানীরা তো এলিটই। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়